ভালবাসার গল্পঃ দূরের তুমি

ভালবাসার গল্প

বিভা কথন –

কাল আমার বিয়ে । আমার কেমন যে লাগছে ! বুঝতে পারছি না । বোঝাটা বোধহয় সম্ভব ও না । শিরশিরে একটা ভয় মেশানো ভাল লাগার অনুভূতি … যদিও বর কিংবা বরের বাড়ি কোনোটাই অচেনা নয় , বরং খুব ভালমতই চেনা । প্রেমের বিয়ে নয় অবশ্য । কেমন যেন ভয় হচ্ছে এইবার । সব ঠিক থাকবে তো ?? এখন অনেক রাত । একটার উপর বাজে । এমন গ্রাম গ্রাম মফস্বল এলাকার জন্য তো শেষ রাত বলা চলে । এইটা বিয়ে বাড়ি , তাই এখনও অনেকে জেগে । এই বাড়িতে আজ আমার শেষ রাত । ঠিক শেষ রাত ও না , আবার নিশ্চয়ই আসবো আমি । তবে তখন হয়ে যাব অতিথি , একটা সাইন করে নিজের বাড়িটা কেমন করে বদলে যায় মেয়েদের , সব ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্য কোথাও , আর কারো ঘরে ।কাল দুপুরের পর থেকে তো ঢাকার সেই একতলা সাদা বাড়িটাই হবে আমার ঘর । আর এইটা হয়ে যাবে বাপের বাড়ি । ও বাড়ির সব আমি চিনি । সবাইকেই ।তবু সব অচেনা লাগবে । ‘ও’র আমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা কে জানে !! কিছু তো বলেও না । হয়েছে নিশ্চয়ই । নাহলে ঢাকার লেখাপড়া করা শিক্ষিত ছেলে নিশ্চয়ই শহরের আধুনিক মেয়ে ফেলে গ্রামের ভূত বিয়ে করে নিয়ে যাবে না !! কি জানি বাবা !! এ ছেলের মতিগতি কিছু বুঝিনা । ‘ও’ আমার সেঝ খালুর আগের পক্ষের ছেলে । এ বাড়িতে কোনদিন আসেইনি সে , ওদের বাড়ি গিয়েছি হাজারবার , হেসে বেশ দু’চার কথা বলতো ; কখনও টুকটাক রসিকতাও । কিন্তু আজ বিকেলে ওরা এসে পৌছানোর পর তিন চার বার তার সামনে দিয়ে গেলাম ইচ্ছা করেই , কিন্তু ফিরেও দেখলো না যেন । কেমন যেন অসুস্থ লাগছিল । সবাই তো ব্যস্ত , কে জানে শরীর খারাপ করলো কিনা । আমি কি একটু যাব ??? কখন থেকেই এইটা ভাবছি । বেহায়ার মত যেতেও লজ্জা লাগছে ! গ্রাম এলাকা , কেউ দেখলে একটা কেলেংকারী হবে…

 

আষাঢ় কথন –

কেমন যে বোধ শূন্য মনে হচ্ছে নিজেকে !! শুধু মনে হচ্ছে , এক দুঃস্বপ্ন দেখছি আর ছটফট করছি ; ঘুমটা কিছুতেই যেন ভাঙগবে না । এই ঘুম আর কখনো ভাঙগবেও না । আমার জীবনটাই এমন হতে হলো ??? রাত কত বাজে জানিনা । মেঘনার পাড়ে বসে আছি । একা… একদম একা… আকাশটা সাদা হয়ে আসছে । সূর্য উঠবে , সকাল হবে । আমার জীবনের সূর্য টা কী আর কখনো উঠবে ??? আজ নাকি আমার বিয়ে !!!

আজ আমার বিয়ের দিন । আর আমি জেনেছি কবে ?? গতকাল দুপুরে । সবাই জানে , সব প্রিপারেশন চলছে । শুধু আমি জানি না । আমাকে এক সপ্তাহ আগে আপু অসুস্থ বলে রাঙ্গামাটি পাঠানো হলো । আমার এয়ারটেলে নেই নেটওয়ার্ক ! কিছুই জানলাম না আমি ?? এক সপ্তাহে আব্বুর বউয়ের বোনের মেয়ের সাথে আমার বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক ??? আমি কে এখানে ??? বিয়েটা কার ?? এই শাস্তি টা কেন আমার জন্য ??? কাউকে ভালবাসি তাই ? নাকি ভালাবাসার মেয়েটা ‘খেয়া’ – এইজন্য ??

গত একটা সপ্তাহ ধরে খেয়ার সাথে কোন যোগাযোগ নেই । একটাবার কথা হয়নি । রাঙ্গামাটি যাবার পথে বাসে করলাম ওর সাথে ঝগড়া ! তাও কি নিয়ে ?? ভার্সিটির ফ্রেণ্ডদের নিয়ে ঘুরতে গেছে , যেখানে কয়টা ছেলেও আছে । কি সিলি একটা ব্যপার , যেখানে জানি খেয়া আমাকে পাগলেওর মত ভালবাসে বললেও কম বলা হয় । মেয়েটার ধ্যান-জ্ঞান বলতেও আমি । আমার ফ্রেণ্ডরা তো রীতিমত হিংসা করে আমাকে । জানিনা ও আমার মাঝে কি পায় ! আজকালকার কোন মেয়ে এভাবে ভালবাসে ?? তবু আমি জ্বালাই ওকে কত !! ঝগড়া করে আমিতো ঘুমিয়ে গেলাম । উঠতেই রাঙ্গামাটি , যেখানে ঘোড়ার ডিমের নেটওয়ার্ক টাও নাই । তারপর আপুকে নিয়ে ব্যস্ততা , বাচ্চাটা অসুস্থ । ভাইয়াও বাইরে । সব করতে করতে সময় পেলাম না , আসলে সময় দেয়া হল না আমাকে খেয়ার সাথে কথা বলার । ফোনটা ও আপু রেখে দিল !!! সবাই মিলে এই কাজ টা কেন করলো ?? জানি আমি , আমাদের সবার সবকিছুই তো খেয়ার বাবার কল্যাণে । দুলাভাইয়ের চাকরীটা , মেঝ চাচা যে অস্ট্রেলিয়ায় আছে তারও সব খেয়ার বাবা অর্থাৎ আমার ছোট চাচার কাজ । বাবাদের খালাতো ভাই ।এই সংসার , আমাদের পড়ালেখা যে চালাচ্ছে তাকে তো খুশি রাখতেই হবে । তাই খেয়ার জীবন থেকে আমাকে চিরতরে সরাতে সবার এই প্ল্যান । আমার কথা , খেয়ার কথা একটাবার কেউ ভাবলো না ??? আব্বু আমার হাতধরে কেঁদেছে … বলেছে , তার মান সম্মান , তার জীবন , ছোট ভাইবোনের সব এমনকি আপুদের লাইফ টাও নাকি আমার উপর নির্ভর করছে । আমার এই এক বিয়েতে সব ঠিক হয়ে যাবে । নাহলে সব শেষ হয়ে যাবে । এই বিধ্বংসী পরিবারের মেয়ের প্রেমেই কেন পড়লাম?? এখন আমার হাতে কি আছে ?? খেয়ার জীবন টাই শেষ করলাম আমি । নিজেরটাও । সব আমার দোষ ??

কাল রাতে ফোনটা অন করার পর থেকে সমানে খেয়ার এস এম এস ঢুকছে । কত হাজার এস এম এস যে সে করেছে এই কদিনে । একটু পর ই শুরু হল ফোন দেয়া । আমি ধরতে পারছি না । ধরে কি বলবো আমি ওকে ??? বলবো আমি কাপুরুষ হেরে গেছি ??? আমার পায়ে পড়তে বাকি রেখেছে শুধু আব্বু , জীবনে আব্বুর কোন কথার অবাধ্য হইনি কোনদিন । সেই ছোট থাকতেই মা চলে গেছে তার কোন বন্ধুর হাত ধরে । আমার কথাটাও ভাবেনি । তখন থেকেই এই আব্বুই আমাকে আগলে রেখেছে । ছোট মায়ের সংসারেও এতটুকু অযত্ন কখনও হয়নি কোনদিন , কোন শখ আহ্লাদ ও অপূর্ণ থাকেনি কখনো । আমিও আব্বু যা পেতে চেয়েছে তাই করে গেছি । ব্রোকেন ফ্যমিলির ছেলে হয়েও আর দশটা ছেলের মত বখে যাই নি । আজ খেয়ার জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না । একটাই যা করতে পারি আমি মরে যেতে পারি । দুকূল রক্ষা হয় আমার । তাতে কে খুশি হবে ?? খেয়া ? না আব্বু ?? কেউই না । আমার মরে যেতে বড্ড ভয় হয় ! আসলেই একটা কাপুরুষ আমি ।

‘ ঠিক সন্ধ্যা নামার আগেই তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে,

মুখ লুকিয়ে কার বুকে তোমার গল্প বলো কাকে ?

আমার রাত জাগা তারা তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি ……’

আমার ফোনটা যে বাজছে এইটা বুঝতে অনেক ক্ষন লাগলো । টিপাটিপিতে কখন যে ফোনটা জেনারেল মুডে নিয়ে আসছি । এই গান টা খেয়ার খুব পছন্দের । গান টা ও নিজে গেয়ে রিংটোন হিসেবে সেট করে দিয়েছিল । হাসতে হাসতে বলেছিল ; শুধু আমি ফোন দিলেই এইটা বাজবে । আমার শব্দে তুমি আমায় পাবে , আমার আওয়াজ শুনে তুমি বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি … আর কারো ভয়েস না ।

খেয়া ডাকছে আমাকে…

 

খেয়া কথন-

অবশেষে ফোনটা ধরল আষাঢ় …

-কই তুমি ??? বল কই ???????

-চাঁদপুর ।

-তুমি বিয়ে করছ তাহলে ?

ওপ্রান্ত নীরব । কি অসহ্য নীরবতা । আমি সহ্য করতে পারছি না । কি করব আমি ?? কি বলব কিছু খুজে পাচ্ছি না । কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে আমার ।

– চুপ করে থাকবা না । কথা বল । কিছু বল প্লিজ । আমি মরে যাচ্ছি আষাঢ় ।

আর পারলাম না আমি । আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম এবং সাথে সাথে লাইন টা কেটে গেল । আমি জানি লাইন কেটে যায়নি । আষাঢ় লাইনটা কেটে দিয়েছে । আমি কি করব বুঝতে পারছি না । কোন কিছু বিশ্বাসই হচ্ছেনা । কিছুতেই না । প্রচণ্ড অস্থির লাগছে । ও আমাকে ভালোবাসে …

ও শুধু ঝগড়া করে , রাগ করে , বকে আমাকে…কিন্তু আমি জানি ও আমাকে ভালো বাসে । ও এইটা কিছুতেই করতে পারে না । আমি জানি দোষটা ওর না । সবটুকুই বাবার কাজ । উনি সামনে কিছুই করেনি কিন্তু আড়ালের কলকাঠী তিনিই নেড়েছেন । ঐ ফ্যমিলিতে বাবার ইচ্ছের বাইরে কেউ কিছু করেনি , করতে চায়নি , আসল কথা পারেওনি । আমাকে নিয়ে ওদের কার কোন সমস্যাই ছিল না । যা হচ্ছে সব বাবার ইচ্ছেতে হচ্ছে ।

আমি সব জানি , শুধু জানি না এখন কি করলে সব ঠিক হবে… আষাঢ় আমার ফোন ধরছে না । একটা এস এম এস করলে কি ও দেখবে ????????

‘jemon kore paro tmi chole asho . amra aaj I nyhow biye korbo . ja hobe dekha jabe . mere to felbena . r Jodi mere fele to kichu bolar nai . bt tumi chole asho, plz… ami kmn koshto hose tmi ki bujhte parcho ????’

এক ঘণ্টা , দু ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে । কোন উত্তর আসছে না । আসছেই না । আমি যেন প্রত্যেকটা মুহূর্ত গুনে যাচ্ছি । আর নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি অপেক্ষায় … কই তুমি … কই ???

ফোনের ভাইব্রেশনে চমকে উঠলাম আমি , কোন ঘোরে যে মরেছিলাম…

1 messege received

হাত কাঁপছে আমার । চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে , কিছুতেই কয়েক টা ইংলিশে লেখা বাংলা কথা পড়তে পারছি না ।

‘‘…mere felle amar apotti nei . kintu tmr baba to amk marben na. tmi to chino tmr baba k ebong amk . nijer sharthe ami kokhonoi r karo khoti korte parbo na . jibone kono onnay ami korini . kintu tmr chokhe onk niche neme gelam . tmr khomar zoggo ami noi . khoma chai o na . shudhu chai tmi valo thako . r shono kheya, tmr kotota koshto hosse ta tmr cheye beshi ami jani . kintu ami kisui korteparchi na . shudhu prarthona kori tmi valo thako kheya , r kisui chai na allah r kase……kokhono bolini tmk kintu onk valobashtam,ekhono bashi………………………..’’

কয়েকটা কথা আমাকে নিংড়ে নিঃশেষ করে দিয়ে গেল । আমার সব কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে । ধোঁয়াশা…

 

বিভা কথন –

এখন পর্যন্ত ওর সাথে একটা কথা হয়নি । বাসর রাতটা কেটেছে লঞ্চে । সেইটা অবশ্য আগেও জানতাম । কিন্তু ও তো একটা বার কথা বলতে পারত এসে । সেই কোন সকালে ঢাকায় এসেছি । বাসায় এসেই সে হাওয়া । একটা বার দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য ও হল না আমার !! পরশু বৌভাত । এই বাসায় আগে কত এসেছি । লুকালুকি খেলতে খেলতে বাসার প্রতিটা কোণ ও আমার চেনা । এই চেনা পরিবেশ , চেনা মানুষজন ; তবু কেমন অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে । আমাদের বাসার সামনে রেইন ট্রী গাছ ছিল । সন্ধ্যা হতেই পাতাগুলো লজ্জাবতীর পাতার মত মিইয়ে পড়তো । কত সন্ধ্যা গাছের নিচে মশার কামড় খেয়েছি পাতার লুকিয়ে যাওয়া দেখার জন্য । নিজেকে এখন সেরকম লাগছে । কেমন যে লজ্জা লজ্জা লাগছে !! খালার বাড়ী শ্বশুর বাড়ি হওয়াতে এমন কিছুই বদলায় নি । বরং সবাই আগের চাইতে অনেক বেশি আদর করছে ।

শুধু ওর ব্যপারটা বুঝতে পারছি না । একটুও কথা বলতে পারছি না । সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন ! কোন বেলায় ঘরে এসে একটু খেয়ে হাওয়া হয়ে গেছেন আবার !! ছেলে , মেয়ে তো না যে আমার মতন লজ্জা পাবে , নিজের ই তো বাড়ি তার । রাত হয়ে যাচ্ছে । এখন তো তুমি আস । নাকি ????? নরমাল একটা শাড়ি পরে আছি । ছোটখালামনির দেয়া । বিয়েতে আসতে পারেনি । অনেকেই আসতে পারেনি । এক সপ্তাহের নোটিশেই বিয়ে ! আমাকে জিজ্ঞেস করল , আমি আপত্তি করিনি । করবই বা কেন ?? আষাঢ় ভাইয়াকে তো… উউউফ আল্লাহ … আবার সেই আষাঢ় ভাইয়া … কতবার চেষ্টা করলাম … তাও যেই চাল সেই ভাত । আষাঢ় , আষাঢ় , আষাঢ় … মুখ দিয়ে খালি ভাইয়া বের হয়ে যায় । এতদিনের অভ্যাস । ওকে তো আমার ভাল লাগতই । ভাল বেসেছি কিনা জানিনা । সেই ওর জন্য আমাকে যখন বলা হল মানা করি কিভাবে ??? ও খুব সাজগোজ পছন্দ করে । সেবার যখন ওরা সব কাজিন রা ট্রলারে ঘুরতে গেল , আমি বাসায় একা ছিলাম , উনি এসে আমাকে জোর করে নিয়ে গেল । তখন খেয়া আপুকে বলছিল টিপ দাও না কেন ? কপাল খালি খালি লাগে । কাজল ছাড়া মেয়েদের একদম মানায় ই না ।

অজান্তেই আমার হাত টা কপাল ছুঁইয়েছিল আর টিপের স্পর্শে শিহরিত হচ্ছিল । মনে হচ্ছিল আমাকে দেখেই যেন খেয়া আপু কে ওই কথা বলেছিল ও । আচ্ছা খেয়া আপুই তো বলব , নাকি ?? বয়সে আমার বড় যদিও , কিন্তু ওর তো ছোট । বিয়ে – সব সম্পর্কই কেমন উলটে পালটে যায় । সকালে যেমন ইশিতাকে আপু বলছিলাম , তখন সেঝ খালামনি বললো , আমি যেন ওকে আপু না ডাকি ইশিতা বরং আমাকে ভাবী ডাকবে । এই সিদ্ধান্তে ইশিতা আপু অবশ্য খুশি হয় নি । খালামনি যাই বলুক ইশিতা আপুকে কষ্ট দিতে চাই না , ওরা ভাবি ডাকতে না চায় , না ডাকলো । আমি যেমন আপু আর ভাইয়া ডাকতাম তাই ডাকব । ওদের ব্যপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । ইশিতা আপু , ঊর্মি , অন্তু , ঐশি , সিম্মি আপু , শায়াণ ভাইয়া , ওর অন্যান্য কাজিন রা আমার সাথে ঠিক সহজভাবে মিশছে না , খারাপ ব্যবহার করছে না , কাছেও তেমন একটা আসছে না । চোখ পড়লেও একটা হাসি দিয়ে উল্টাদিকে চলে যাচ্ছে । অথচ আমার ভাইয়ার যখন বিয়ে হল আমি তো পারলে ভাবীর সাথে আঠার মত লেপ্টে ছিলাম । কি জানি !! শহরের মানুষগুলো হয়তো এমন ই । এখানেই আমাকে মানিয়ে নিতে হবে । ভাবতে ভাবতে কিসব ভাবতে বসেছি ??? কত রাত হয়ে গেছে , ঘুম আসছে । কত চিন্তায় , আশংকায় , ভাবনায় গত সাত আট টা রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি ।এখন আমি ঘুমিয়ে পড়লে ,ও যদি এসে দেখে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি আমি !! কি লজ্জার ব্যপার হবে ।

 

আষাঢ় কথন –

খেয়ার ফোন সুইচড অফ । যতই ভাবছি ওকে ফোন দেয়া উচিত না , তাতে তার কষ্টটাই বাড়বে শুধু । এতটুকু কমবে না । তবু অজান্তেই ফোন টা চলে যাচ্ছে । ভাগ্য ভাল যে ও ফোন অফ করে রেখেছে । রাত ১২টা বাজবে একটু পরেই । তিন টা রাত ঘুমাই না । ঘুমে চোখ পড়ে আসছে , প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছে । বাসায় যেয়ে একটু শুতে পারলে হত ।কিন্তু কোন ঘরে যাব ?? ঐ ঘর টা তো আরেকজন দখল করে ফেলেছে । তার ই বা কি দোষ ?? কিন্তু তুই ই বা বিয়েতে রাজি হলি কেন ?? অবশ্য সে রাজি না হলে কি ই বা আমার মাথা হইতো ? তখন বলির পাঠা হইতো আর এক মেয়ে । কোন নিলা , নিরা , শিলা । ঐ বিছানায় আরেক টা মেয়ে নিয়ে কিকরে শুই আমি ? আমার সিঙ্গেল বেডে রাতে প্রায় ই পড়ে যাইতাম । রাতে বিছানায় ক্লক ওয়াইজ এন্টি ক্লক ওয়াইজ ঘুরার অভ্যাস আমার ছোট বেলার । সেদিন তো খেয়ার সাথে কথা বলতে বলতে ই ঠাশ !!! খেয়া তো হেসেই খুন । দুদিন পর হঠাত ফোন , বাসা থেকে বের হও ।

বের হয়ে দেখি । একটা মালগাড়ি । মানে পিক আপ । একটা লোক একটা কাগজ বের করে বললো , স্যার , সাইন করেন । খেয়া ম্যাডাম পাঠিয়েছেন ।

আস্ত একটা অটবির ডাবল বেড … এত্ত সুন্দর !! মেয়েটা পারেও ।

আমি অবশ্য একটু রেগেই গিয়েছিলাম । একটু বকা দিতেই কান্না কান্না গলায় খেয়া বললো ,

– শুন , এইটা আমি বাবার টাকায় কিনি নাই । এইটা আমার টীচিং এসিস্ট্যন্টশিপের টাকায় কিনা । বুঝছো ??

– কিন্তু ঐ টাকায় তুমি না নিজের জন্য কি কিনবা বলতেছিলা ???

– নিজের জন্য ই তো কিনলাম । তুমি কি ভাবছ এত কষ্টের টাকায় তোমার জন্য কিনব ?? ঐ বেড টা তো আল্টিমেটলি আমার ই হবে । আমি ই তো থাকব নাকি ???

– তা থাকবা ।

– নাকি আর কাউকে আনার প্ল্যান ???

বলেই হেসে ফেলেছিল । কত রকম করে যে সে হাসতে পারত !!

খেয়া কি জানত ওর শখের সেই বেডে আর একজন আমার বউ হয়ে অপেক্ষা করবে কোনদিন ??? ওর মজা করে বলা কোন কথা এত টা সত্যি হয়ে আসবে আমার জীবনে । আমি বাসার দিকেই হাটছি , কিন্তু পা চলতে চাইছেনা ।

বিভা ঘুমিয়ে পড়েছে । আমি জানি না আমার কি হল , আমি ওকে ডেকে ফেললাম …

ধড়মড় করে উঠে বসল সে । অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে । এত মায়া লাগছে … তবু বললাম… কঠিন গলায় … –

বিভা , আজ রাত টা একটু কষ্ট করে এই সোফায় শোও প্লিজ ???

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে । এই কথা হয়ত বেচারী আশা করেনি । আমি কি করব ? দু দিকেই অন্যায় করছি জানি । কেউ শুনলে হয়ত হাজার টা নীতিবাক্য ঝাড়বে । কিন্তু আমার মনে যে কি চলছে তা কেবল আমিই জানি ।

 

খেয়া কথন –

কিছুই করিনা আমি ।কিছুই না । সারাদিন দরজা বন্ধ করে একা বসে থাকি । কোথাও যাই না । ইচ্ছে হলে কিছু খাই বের হয়ে , নইলে না। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না । কেমন মরা মানুষের মতন বেঁচে আছি । ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরার মতন ঘুমাই । ইচ্ছা করছে আষাঢ় কে নিয়ে কোথাও ছুটে পালাই । ইশিতার সাথে কথা হয়েছে শুধু আজ সকালে । আজ নাকি ওর বৌভাত । আমি জানি ইশিতারা কেউ বিভাকে সহ্য করতে পারছে না । আমি জানি । সব এলোমেলো হয়ে গেছে । কিছুতেই কি ঠিক হয় না ??? কিছুতেই কি আমি আর পাব না আষাঢ় কে ???????? আমি আষাঢ় কে ছাড়া আর পারছি না । আমি সহ্য করতে পারছিনা । চিৎকার করে কাঁদি কতক্ষন !!! ভিতর টা ছিড়ে যাচ্ছে আমার ।

 

সাত বছর পর

একে অপরকে এত চাইল তারা , তবু কেউই কার হল না । সবচেয়ে কাছের মানুষ ই হয়ে গেল সবচেয়ে দূরের । যাকে ধরা ছোঁয়া ও যায় না । মেণ্টাল এসাইলাম এ এখন একাই ভাল আছে আষাঢ় । হঠাত কখনো আসে কেউ । কাউকেই চিনে না সে । কাউকেই না । অন্তর কেও না । খেয়ার বাবার ই হসপিটাল । খেয়া মারা যাওয়ার পর আষাঢ় কে নিয়েই মেতে আছেন তিনি । আষাঢ় আর অন্তর । অন্তর , খেয়া আর আষাঢ় এর ছেলে । কেউ জানত না , হয়ত খেয়া নিজেও না । নিজের অজান্তেই নিজের ভেতর আদরে লালন করছিল একটা শিশুকে । ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরতে চেয়েছিল খেয়া আষাঢ় – বিভার বৌভাতের দিন । মরেনি খেয়া, বরং বাঁচার রসদ পেয়েছিল অন্তরের অস্তিত্ব এর কথা জেনে । খুশি ই হয়েছিল সে । শুধু সেই । আর কেউ না । আষাঢ় ও না । বিভা কেমন পাথর হয়ে গেছিল । বিভা তবু ছিল , সে তবু আষাঢ় এর সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখছিল । কিন্তু আষাঢ় তখনি এবনরমাল হয়ে যেতে থাকে । খেয়ার বাসার দরজায় বসে থাকত , খেয়া দেখা দিত না । কিন্তু ততক্ষণ সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত । এক মনে সে দেখত আষাঢ় কে । খেয়ার বাবা মা একদম ভেঙ্গে পড়েছিল । খেয়া যেন তাতে আরও খুশি হয়ে গেছিল । মনে হচ্ছিল ও যেন প্রতিশোধ নেবার এক অস্ত্র খুঁজে পেয়েছে । শেষদিকে উঠে দাঁড়াতে পারত না খেয়া । এতটাই দূর্বল হয়ে গেছিল । খেয়ার বাবার তাও প্ল্যান ছিল বাচ্চাটা হলে কোন ভালো ফ্যমিলিতে দিয়ে দিবেন । আর খেয়াকে নিয়ে বাইরে কোথাও চলে যাবেন । নতুন করে নতুন পরিবেশে খেয়া তার জীবন শুরু করবে । এই চান্সটুকুও খেয়া দিল না কাউকে । বাবাকে প্রতিদ্বন্ধী করেছিল সে । তাই অন্তর কে জন্ম দিয়েই হারিয়ে গেল সে । আর খেয়ার বাবা মা অন্তরের মাঝেই খুজে পেলেন তাদের খেয়াকে । আষাঢ় হয়ত আর সহ্য করতে পারছিল না । পারলোও না সে । বিভা চেয়েছিল নতুন করে আবার শুরু করতে আষাঢ় আর অন্তরকে নিয়ে , কিন্তু তাও হল না । খেয়া যেতেই আষাঢ় ও হারিয়ে গেল অন্য জগতে । না কিছু শুনে , না কিছু চিনে । তাতেই বোধ হয় ভাল আছে সে ।

৬ বছরের অন্তরকে নিয়েই মধ্যবয়সী এক দম্পতির দিন কেটে যায় ……………

Related posts